‘বিজু ,বৈসু, সাংগ্রাই’ পাহাড়ে উৎসব, আনন্দ, আশা ও স্বপ্ন এই তিনটি শব্দের মধ্যে।  ফুল বিজু, মূল বিজু ও গচ্চ্যে পচ্চ্যে বিজু তিন দিন ধরে চলবে বিশেষ আয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের আদিবাসীরা মূলত- চাকমা, ত্রিপুরা,মারমা, তঞ্চঙ্গ্যারা বর্ষ বিদায় এবং নও বছর বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ২৮ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ রাত ১২ থেকে শুরু হয়েছে ফুলবিজুর আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিনকে চাকমারা ফুলবিজু হিসেবে পালন করে থাকেন।

২৮ চৈত্র বিকেল থেকেই এই আয়োজন শুরু হয়ে যায়। আয়োজন চলে সারারাত ধরে। পরদিন ভোরে ফুল তুলে গঙ্গা মায়ের (জলদেবীকে) পুজো দেওয়া হয়। মূলত জীবনের প্রতিটি কাজে পানি’র অবদানকে স্বীকার করার জন্য, পানির প্রতি কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ এই পুজো। এছাড়া গঙ্গা মাকে সন্তুষ্ট করার জন্যই এই আচার। ভোর রাতে বাঁশ, ফুলের ঝুড়ি, টর্চ লাইট নিয়ে দল বেধে ফুল চুরি করতে যাওয়া। ফুল চুরি করতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খাওয়া আর-ও কতশত কাহিনী জমা হয়ে যায়। পাহাড়ের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পর্যন্ত বিকেলের খেলা ভুলে দিন তারিখের হিসাব করতে থাকে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। পাড়ার বৃদ্ধ মহিলাটি এই পাহাড় হতে ওই পাহাড়ে সবজি খুঁজে বেড়ায় কড়া রোদ উপেক্ষা করে। কুলোয় করে নিয়ে যায় হাটবাজারে বিক্রি করতে। কারণ বৈসাবি আসছে সামনে, আদরের নাতি-নাতনিদের কিছু তো উপহার দিতে হবে। সব বাড়িতে উষ্ণ এক আভা জ্বলজ্বল করে। পাহাড়ের হাওয়া বদলে যায়। প্রকৃতি জানান দেয় আগমনের বার্তা। দিন যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে সময় যেন দীর্ঘ হতে থাকে। সকালের প্রথম সূর্যকে দেখে তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, শিশু নদীতে ফুল দিয়ে বরণ করে বৈসাবি ( বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু)। সবার একটাই প্রার্থনা পুরনো সব জরা ব্যাধি যেন দূর হয়ে যায়, সবার জীবনে যেন শান্তি বর্ষিত হয়।যুগ যুগ ধরে পালিত এই উৎসব আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। একটার পর একটা বছর আসবে যাবে। কিন্তু এই উৎসব সবসময় পুরনো হয়ে নতুন করে আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।
প্রচলিত কথা থেকে জানা যায়, গঙ্গা মা (জলদেবী) রুষ্ট হলে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যাবার ভয় থাকে। তাই সারা বছরের ভুলত্রুটি মার্জনা চেয়ে জলদেবীকে প্রসন্ন করার জন্য এ পুজো দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি পানির যত উৎস আছে সেখানেও ফুল নিবেদন করা হবে। যেমনঃ কুয়া,ছড়া, ঝর্ণা,ঝিরি যা থাকে পাহাড়ি পানির উৎস। গ্রামে গবাদি পশুদের জন্য খাবার, চাল,গম,ভাত ছিটানো হবে যাতে পশুপাখিরা খেতে পারে। ঠিক একই ভাবে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পানির উৎসে (ছড়া,নদী,কুয়া,ঝর্ণা,ঝিরি) এবং সবুজ বৃক্ষের নীচে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হবে প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যে প্রকৃতি সারা বছর ফুল,ফল দেয় সেই প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য এই প্রথা। এই দিনে পরিবারে এবং গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের স্নান করানো হয়। আগেকার দিনে পানির উৎস অনেক দূরে হওয়ায় তাঁরা নদীতে যেতে পারেন না বলেই তাঁদের বিশেষ নিয়মে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়। তবে কালের বিবর্তনেও ঐতিহ্যবাহী প্রথাটা টিকে রয়েছে।
ছবি: জয়ীতা চাকমা