MHDAY2021_Shaida

২৮ মে পিরিয়ড পরিচ্ছন্নতা দিবস বা বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে উৎযাপন করা হয় বিশ্বব্যাপী। স্বাস্থ্যকর মাসিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সুরক্ষা সবকিছুতেই প্রভাব পড়ে। মাসিক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, প্রচলিত কুসংস্কার, জড়তা বা খোলামেলা আলোচনায় নানাবিধ বাঁধা সবকিছুই মাসিকের মত অতিপ্রাকৃতিক বিষয়টিকে একটি নিষিদ্ধ বিষয়ের রুপ দিয়েছে। আমাদের সমাজ খুবই আধুনিক হলেও মাসিক বা রজঃস্রাব এর কথা বলতে গেলেই খুব সেকেলে বা ব্যকডেটেড হয়ে যায়।

নিজেদের সবসময়ই আধুনিকতার মোড়কে জড়িয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা মানুষগুলো যখনই পিরিয়ড, ঋতু, মাসিক এর কথা শুনে তখনই খুব অস্বস্তি বোধ করা শুরু করে। পার্বত্যাঞ্চলে মাসিকের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে স্বাভাবিক ও মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনার পথ সুদৃঢ় করতে সামাজিক আন্দোলন জোরদারে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অপরাজিতা’।

৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে নারীদের মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করা হয় অপরাজিতা। ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবী ও ২১ জন সদস্য নিয়ে খুবই স্বল্প সময়ে পাহাড়ের নারীদের সচেতন করার নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। ব্যতিক্রমধর্মী কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ ইতোমধ্যেই স্থান পেয়েছে জাতীয় পর্যায়ের সংগঠনগুলোর সাথে একীভূত হয়ে কাজ করার সুযোগ। রাঙামাটি জেলার ৪টি উপজেলায় ইতোমধ্যে কার্যপরিধি বিস্তৃত করেছে এবং এপর্যন্ত প্রায় ১৫০০ পরিবার প্রত্যক্ষভাবে সংগঠনের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছে। মাসিককালীন স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করে থাকে অপরাজিতা।

এপর্যন্ত রাঙামাটিতে ৮টি ক্যাম্পাস একটিভেশন, ১২টি ফিল্ড ভিজিট, ৫টি কৈশোর কর্মশালার আয়োজন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। করোনা অতিমারীর মধ্যেও কার্যক্রম থেমে থাকেনি। অনলাইনে ১৫টির অধিক কর্মশালার আয়োজন করেছে তাঁরা। এই কর্মশালায় কিশোর-কিশোরী, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, উন্নয়নকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের সাথে জড়িত বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ সংযুক্ত হয়েছেন। অপরাজিতার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৪৬০০০ এর অধিক মানুষ পেয়েছে মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সঠিক তথ্য।

অপরাজিতা মাসিকবান্ধব টয়লেটের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এছাড়াও নিরাপদ ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার এর ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছে। সংগঠনটির রয়েছে নিজস্ব কলসেন্টার সুবিধা। এই সুবিধার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে কিশোর-কিশোরীদের নানান জিজ্ঞাসা, মাসিক স্বাস্থ্য ও ঋতুস্রাব নিয়ে কোন প্রশ্ন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনপ্রকার হেনস্থার শিকার হলে বা আপত্তিকর যেকোন ঘটনার তড়িৎ সমাধান নিশ্চিত করা হয়।

এপর্যন্ত ৩টি বাল্যবিবাহ রুখতে সক্ষম হয়েছে অপরাজিতা। ৭টি সাইবার বুলিং সমস্যার আইনগত সমাধান দিয়েছে এবং ৯টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাউন্ট পুনরুদ্ধার করেছে।

এবারের পিরিয়ড পরিচ্ছন্নতা দিবস বা বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, “মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কার্যকর উদ্যোগের প্রতি বিনিয়োগ বৃদ্ধি”। মাসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিন্তে বরাবরই মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে অপরাজিতা। যেসকল বিষয়ে পার্বত্যাঞ্চলে অপরাজিতা কাজ করছে তা টেকসই লক্ষ্যমাত্রাকে মাথায় রেখেই। ‍২০৩০ সালের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বদ্ধপরিকর এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এমন জাদুকরী যুগে এসেও পার্বত্যাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এখনো অনেক উদ্বিগ্নতা ও সমন্বয়হীনতা রয়ে গেছে। অপরাজিতা চেষ্টা করছে একটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে পাহাড়ের আনাচে কানাচে মাসিক স্বাস্থ্যসেবায় প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিতে।
প্যাড ভ্যান্ডিং মেশিনের প্রোটোটাইপ নিয়ে কাজ করছে অপরাজিতার আর এন্ড ডি টীম।

অপরাজিতার সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ-বিন-জাহিদ (মিকি) জানান, “অপরাজিতা মূলত কাজ করছে নারীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও মুক্তির জন্য। একজন নারী তখনই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন যখন আমরা তাঁকে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবো। পিছিয়ে পড়া কথাটি কখনোই সন্তোষজনক নয়। আমাদের পাহাড়েও সম্ভাবনা আছে। অভাব শুধুমাত্র বিনিয়োগ। আপনারা বিনিয়োগ নিশ্চিত করুন, আমরাই কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ বাতলে দিবো। আমাদের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমেই আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহারে মনোনিবেশ করেছি। যার ফলাফল নিকট ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন পার্বত্যবাসী। ”

অপরাজিতার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সাইদা জান্নাত জানান, “আমরা নারীর অপ্রতিরোধ্য যাত্রায় আসা সকল বাঁধাকে অতিক্রম করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। খুবই কম সময়ে আমাদের গৃহিত সকল উদ্যোগ ছিলো ফলপ্রসূ এবং আমাদের সাথে দেশের শীর্ষস্থানীয় সংগঠনগুলোকেও আমরা সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়ায় আছি।
আমাদের এখন প্রয়োজন বিনিয়োগ। কারণ, মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গেলে অনেকগুলো বিষয়ের প্রতি আপনাকে মনোনিবেশ করতে হবে। একজন কন্যাশিশুর কৈশোর ও তার যৌবনকাল পুরোটা জুড়েই তাঁকে মাসিকের মাধ্যমে অতিবাহিত করতে হয়। তাই তাঁর পিছনে বিনিয়োগটাও হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক ও ধারাবাহিক।

করোনা অতিমারীর জন্য এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঘরে ঘরে গিয়ে মাসিক সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন অপরাজিতার স্বেচ্ছাসেবীরা। সাধারণ সম্পাদক পলি ত্রিপুরার নেতৃত্বে রাঙামাটির ৬নং বালুখালী ইউনিয়নের কিল্লাপাহাড়ে স্যানিটারী ন্যাপকিন, ডিগনিটি বক্স ও পিরিয়ড ব্রেসলেট বিতরণ করা হয়। মোট ১৬টি পরিবারের কিশোরী ও নারীদের এই উপহার সামগ্রী বুঝিয়ে দিয়ে মাসিক নিয়ে তাঁদের সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করা হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।

পিরিয়ড ব্রেসলেটের মাধ্যমে মাসিকের দিনগুলোয় সচেতন থাকা আরো সহজ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। এছাড়াও ডিগনিটি বক্সের মধ্যে থাকা সরঞ্জামাদি মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নারীদের যত্নে সহযোগী ভূমিকা পালন করবে। স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করার মাধ্যমে অপরিচ্ছন্ন কাপড় ও অনিরাপদ অভ্যাসের কারনে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে পাহাড়ের নারীরা।

মাসিক নিয়ে প্রচলিত সকল ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে বিষয়টি নিয়ে সচেতন করে এগিয়ে যাবার এখনই সময়। অপরাজিতার সচেতনতার লড়াইয়ে সকলের সাহসী অংশগ্রহণ ও সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ নিশ্চিতে এগিয়ে আসাটা সময়ের দাবী।