আমি অপরাজিতা

প্রত্যেক নারীর জীবনের প্রথম মাসিক হওয়ার দিনটি হওয়া উচিত আনন্দের ও স্বাচ্ছন্দ্যের। সেজন্য বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই মাসিক সম্পর্কে জানা ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

  • মাসিক কী এবং কেন হয় – এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পরিবার, কাছের বন্ধু-বান্ধব বা অনলাইনের মাধ্যমে জানা ।
  • মাসিক যে একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিষয় সে সম্পর্কে অবগত থাকা ।
  • মাসিকের আগে মানসিক প্রস্তুতি নেয়া যাতে তা কোনভাবেই ভয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় ।
  • সাধারণত মাসিক শুরুর ৬ থেকে ১২ মাস আগে যোনিপথ দিয়ে হলদেটে ও সাদা রঙের স্রাব বেরিয়ে আসে। এ সময়টা সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখা এবং এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে অভিভাবককে জানানো ও খোলামেলাভাবে কথা বলা ।
  • মাসিকের সময় কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে যা স্বাভাবিক – সেগুলো সম্পর্কে জানা। যেমন: ক্ষুধা না পাওয়া, বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, তলপেটে ব্যথা।
  • এ সময় যে মানসিক লক্ষণগুলো দেখা দেয়, যেমন: মানসিক বিষণ্ণতা, মেজাজের পরিবর্তন এসব কিছু যে স্বাভাবিক সেই সম্পর্কে অবগত থাকা ।
  • মাসিকের সময় স্কুলে বা বাইরে কোথাও গেলে ব্যাগে প্যাড বা মাসিকের কাপড় রাখা, সাথে পলিথিন রাখলে ব্যবহৃত মাসিকের কাপড় বদলাতে সুবিধা হবে ।
  • মাসিকের সময় হালকা খেলাধুলা ও ব্যায়াম করা, কারণ তা মাসিকের রক্ত সহজে বের হয়ে যেতে ও তলপেটে ব্যথা কমাতে সাহায্য করে ।
  • অন্যান্য সময়ের মত মাসিকের সময়ও সব স্বাভাবিক কাজ করা ।
  • মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চলা ও পরিচ্ছন্ন থাকা যাতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ না হয় ।
  • পর্যাপ্ত বাতাস ও রোদ আসে এমন জায়গায় মাসিকের কাপড় শুকাতে দেওয়া। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় কাপড় না শুকানো ।
  • ব্যবহৃত প্যাড কাগজে ভালোভাবে মুড়িয়ে আবর্জনা ফেলার জায়গায় ফেলা ।
  • প্রতি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পর পর প্যাড পরিবর্তন করা। রক্তপ্রবাহ বেশি হলে আরো কম সময়ের মধ্যেও পরিবর্তন করতে হতে পারে ।
  • অন্যান্য সময়ের মত মাসিকের সময়ও আয়রনযুক্ত ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া ।
  • স্কুলে মাসিক হয়ে গেলে বন্ধু-বান্ধবী ও শিক্ষককে জানানো যাতে তারা সাহায্য করতে পারেন ।
  • খুব বেশি শরীর খারাপ না লাগলে, রক্ত লেগে যেতে পারে বা স্কুলে ছেলেমেয়েরা কটুক্তি করতে পারে এই ভয়ে মাসিকের সময় স্কুল কামাই না দেয়া ।
  • মাসিক নিয়ে স্কুলে কোন ছেলে বা মেয়ে সহপাঠী খারাপ মন্তব্য করলে বা হাসাহাসি করলে তাতে মন খারাপ না করে তাদেরকে মাসিক সম্পর্কে দৃঢ়তার সাথে সঠিক তথ্য দেয়া ।
  • মাসিক সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো জানা এবং তা ভেঙে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জীবনযাপন করা ।

মা-বাবা

মাসিকের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হলো পরিবার। মাসিক বিষয়ক তথ্য যেন সঠিক হয় তার জন্য মা-বাবার বয়ঃসন্ধি ও মাসিক সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা থাকা দরকার। সেই সাথে ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের সাথে সহজ সম্পর্ক রাখা জরুরি যাতে পরিবারে মাসিক নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলার মত পরিবেশ তৈরি করা যায়।

  • মেয়ের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা এবং সে যেন বয়ঃসন্ধির সময় তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়গুলো সহজে বলতে পারে সেই পথটা সুগম করা।
  • মাসিকের আগে মাসিক সম্পর্কে মেয়েকে ধারণা দেয়া এবং একই সাথে ছেলের সাথেও আলাপ করা যেন সেও সঠিক তথ্য জানতে পারে পরিবার থেকেই।
  • মাসিক নিয়ে মা তার নিজের অভিজ্ঞতা মেয়েকে গল্পের ছলে বলতে পারেন এবং বিষয়টা স্বাভাবিক ও সব মেয়েরই হয় তাই এতে ভয়ের কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করা।
  • মেয়েকে মাসিককালীন নানা উপকরণ, যেমন: মাসিকের কাপড়, প্যাড সম্পর্কে ধারণা দেয়া
  • মেয়েকে মাসিক সম্বন্ধে ইন্টারনেটে নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে পড়তে আগ্রহী করা।
  • মাসিকের সময় মেয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খেয়াল রাখা।
  • মাসিক বিষয়টি প্রায়ই কাল্পনিক বিধিনিষেধ দিয়ে বেষ্টিত থাকে। তাই শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবে যেন কোন ধরনের কুসংস্কার ও ভুল তথ্য ছোট্ট মেয়েটির উপর মানসিক ও শারীরিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
  • মেয়েকে নিজের যত্ন নিতে শেখানো, নির্দিষ্ট সময় পর পর প্যাড পরিবর্তন ও কাগজ দিয়ে প্যাড ভালোভাবে মুড়িয়ে আবর্জনায় ফেলার জায়গায় ফেলানোর বিষয়ে তথ্য দিয়ে সাহায্য করা।
  • মেয়েকে মাসিকের সময় তার প্রয়োজন বুঝে প্যাড কিনে দিয়ে সাহায্য করা।
  • মাসিক নিয়ে তার যেকোন প্রশ্নের স্বতস্ফূর্তভাবে উত্তর দেয়া।
  • যদি ১৩ বছর বয়সেও মাসিক শুরু না হয় তবে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া।
  • মাসিক সংক্রান্ত যেকোন জটিলতায় মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করা ও উৎসাহ দেয়া।
  • বাসায় ও স্কুলে মাসিকবান্ধব টয়লেট নিশ্চিত করা। স্কুলে শিক্ষকদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা।

ভাই-বোন

যদি বোনের আচরণে ও শারীরিক দিক থেকে পরিবর্তন চোখে পরে তাহলে বুঝতে হবে সে বড় হয়ে উঠছে। তার এই মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের সময়গুলোতে তার ভাই বা বোন হিসেবে তার প্রতি সাহায্যকারী মনোভাব রাখাটা খুব জরুরি। সব ছেলেমেয়েই ৯ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই সময়কালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। আর এ সময়ই মেয়েদের মাসিকের শুরু হয়।

ছেলে বা মেয়ে যে-ই হও না কেন, বোনের চেয়ে বয়সে ছোট বা বড় হও না কেন, নিজের বোনের এই পরিবর্তনের সময় তার ভাই-বোনের সাহায্য প্রয়োজন। ভাই বা বোন হিসেবে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া একান্ত কর্তব্য।

  • বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে জানা
  • মেয়েদের মাসিক কেন হয় এবং মাসিক কী – সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা।
  • মাসিকের সময় যে কোন প্রয়োজনে বোনকে সাহায্য করা।
  • মাসিকের সময় প্যাড কিনতে বা স্কুলে যাওয়ার সময় সাহায্য করা।
  • মাসিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলা।
  • অন্যান্য ছেলে বন্ধুদের মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানানো এবং মাসিকের সময় যেন এ নিয়ে বাজে রসিকতা না করে ও মেয়েদের উত্ত্যক্ত না করে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা।
  • মাসিক শুরু হওয়ার কিছু দিন আগে যদি বোনের মেজাজ খিটখিটে থাকে তাহলে তার সাথে সহানুভূতি নিয়ে আচরণ করা যেহেতু তা মাসিক পূর্ববর্তী লক্ষণের একটি।
  • বোন যেন মাসিকের সময় লজ্জা না পায় এবং অস্বস্তিবোধ না করে সেজন্য সাহায্য করা।
  • বোনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে উৎসাহিত করা ।

আত্মীয় – স্বজন

মেয়েশিশু পরিবারের সম্পদ। মেয়েরা ছেলেদের মতোই ভবিষ্যতে পরিবারের দায়দায়িত্ব নিতে পারে; জীবনে সফল হয়ে সবার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু সে জন্য পরিবারের অন্যান্যদের উচিত তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হওয়া।

মাসিকের সময় মেয়েশিশুর যত্ন নেয়া শুধু মা-বাবার একার দায়িত্ব নয়। পরিবারের সবারই উচিত এ সময় মেয়েটির সুবিধা-অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা। অনেক সময় দেখা যায় অল্প বয়সী মেয়েরা মায়ের চেয়েও পরিবারের অন্য নারী সদস্য, যেমনঃ নানী-দাদী, খালা বা ফুপুর সঙ্গে সহজে কথা বলতে পারে।

ফলে পরিবারের সদস্য হিসাবে আত্মীয়দের দায়িত্ব তাকে সাহায্য করা, তার যত্ন নেয়া। আর মাসিকের সময় তাকে সাহায্য করতে হলে মাসিক সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন।

  • মাসিক ও বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা।
  • পরিবারে কারো প্রথম মাসিক হলে তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করা এবং তাকে মাসিককালীন উপকরণ পেতে সাহায্য করা।
  • মাসিক চলছে এমন কোন মেয়ে আত্মীয়-এর বাসায় বেড়াতে এলে তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করা, সে অস্বস্তিবোধ করতে পারে এমন কোন কথা না বলা বা ব্যবহার না করা।
  • যদি আত্মীয়-এর বাসায় বেড়াতে গিয়ে মাসিক হয়ে যায় তবে মেয়েটিকে প্যাড দিয়ে সহযোগিতা করা।
  • মাসিককালীন পুষ্টিকর খাবার খেতে ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে সাহায্য করা ও উৎসাহ দেয়া ।

বন্ধু ও সহপাঠী

শিক্ষার্থী জীবনে দিনের বড় একটা অংশ বিদ্যালয়েই কাটে। তাই মাসিকের সময়টা ক্লাসের বন্ধু ও সহপাঠীদের সহায়ক মনোভাব ও সাহায্য একান্তভাবে কাম্য।

  • বয়ঃসন্ধি ও মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা।
  • ক্লাসে কোন বান্ধবী বা সহপাঠীর মাসিক হলে তাকে প্যাড দিয়ে সাহায্য করা।
  • ক্লাসে কোন বান্ধবী বা সহপাঠী মাসিককালীন ব্যথা অনুভব করলে তাকে কমনরুমে নিয়ে যেতে সাহায্য করা ও শিক্ষককে জানাতে এগিয়ে আসা।
  • মাসিক চলছে এমন কোন বান্ধবী বা সহপাঠীর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করা এবং সে লজ্জাবোধ করতে পারে এমন কোন আচরণ না করা।
  • মাসিক যে একটি স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক বিষয় সে বিষয়ে অবগত থাকা ও কোন ধরনের ভুল তথ্য দিয়ে ক্লাসের কাউকে বিভ্রান্ত না করা।
  • মাসিক নিয়ে ছেলেমেয়ে সবার সাথে ক্লাসে খোলামেলা কথা বলা এবং সব ধরনের লজ্জা ও গোপনীয়তা দূর করা।
  • মাসিকের সময় খুব বেশি শরীর খারাপ না লাগলে যেন স্কুল কামাই না দেয় সেজন্য বান্ধবীকে উৎসাহিত করা।
  • মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা বা অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে যদি কোন বান্ধবী বা সহপাঠী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে তবে পরবর্তিতে তাকে ক্লাসের পড়া বুঝতে সাহায্য করা ।

প্রতিবেশী

মাসিককালে একটি মেয়ে কতখানি আত্মবিশ্বাসী থাকবে তা অনেকটা নির্ভর করে তার প্রতি প্রতিবেশী বা এলাকাবাসীর স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। তাই মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা এবং মাসিকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এমন কোন মেয়ের প্রতি সাহায্যকারী মনোভাব রাখাটা খুব প্রয়োজনীয়।

  • বয়ঃসন্ধি ও মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা।
  • মাসিকের সময় প্রতিবেশী মেয়েটিকে প্যাড বা যে কোন মাসিককালীন স্বাস্থ্যকর উপকরণ কিনতে সাহায্য করা।
  • মাসিকের সময় প্রতিবেশী মেয়েটির সাথে স্বাভাবিক আচরণ করা।
  • মাসিক নিয়ে কোন কুসংস্কার বা ভুল তথ্য না দেয়া এবং কোন প্রকার ভয় না দেখানো।
  • মাসিকের সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চলতে উৎসাহিত করা ।

শিক্ষক-শিক্ষিকা

শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য মাসিক সম্পর্কিত তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। শিক্ষকরা স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্য বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

  • বয়ঃসন্ধি ও মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা।
  • ক্লাসে শারীরিক শিক্ষার যৌন ও প্রজনন শিক্ষার অধ্যায়টি গুরুত্ব সহকারে পড়ানো।
  • স্কুলে মাসিকবান্ধব টয়লেট নিশ্চিত করা।
  • স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপের মাধ্যমে মেয়েদের জন্য কমনরুম নিশ্চিত করা।
  • মাসিকের সময় মেয়েদের স্কুলে আসতে উৎসাহিত করা।
  • ক্লাসে ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহণে মাসিকবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা।
  • ক্লাসে কোন ছাত্রীর মাসিক হয়ে গেলে তাকে মাসিককালীন উপকরণ (প্যাড) দিয়ে সাহায্য করা।

Facebook | Twitter