প্রতিবছর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে। দেশগুলো নিজেদের মতো করেই দিবসটি উদযাপন করে। এই উদযাপনেও থাকে ভিন্নতা। অনেক দেশে এই বিশেষ দিনটিতে নারীদের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে নারী দিবসকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।

নারী দিবস পালনকে কেন্দ্র করে বিতর্কও রয়েছে আমাদের মাঝে। একটি বিশেষ দিন কেন্দ্র করেই কেন নারীকে নিয়ে এতো আয়োজন?

কেউ আবার মনে করেন, নারীর প্রাপ্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দিতেই নারী দিবস পালনের দরকার। মতভেদে অন্যরা মনে করেন, নারীদের জন্য আলাদা দিবস উদযাপন করার মাধ্যমেই বরং নারীদের দুর্বল করে দেখানো হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে দু’পক্ষেরই বক্তব্যই যথাযথ ও যুক্তিসঙ্গত। তবে, এখনো যেহেতু নারীর প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, তাই নারী দিবসকে কেন্দ্র করে বছরে একটি দিনও যদি সমাজের ভাবনায় বিষয়টি সচেতনভাবে উঠে আসে, তাতে ক্ষতি কি!

নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নানা জনের নানা ভাবনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নারীর অর্জন উদযাপন করা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি সমাজে নারীর সমতার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এ লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোও এর আরেকটি উদ্দেশ্য।

এ বছর – ২০২২ এ, নারী দিবসের প্রতিপাদ্য “পক্ষপাত ভাঙা” (#BreakTheBias)। The International Women’s Day ওয়েবসাইটে জেন্ডার-সমতাভিত্তিক একটি বিশ্ব নির্মাণের আহ্বান জানানো হয়েছে যেখানে কোনো পক্ষপাত থাকবে না এবং নারীরা সব ধরনের Stereotype ও বৈষম্য থেকে মুক্ত থাকবে।
জাতিসংঘের Theme ‘টেকসই আগামীর জন্য আজ জেন্ডার সমতা’ (Gender Equality Today For A Sustainable Tomorrow)। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে একটি টেকসই পৃথিবী গড়তে হলে এখনই নারীর প্রতি বৈষম্য ও পুরুষের প্রতি পক্ষপাত দূর করে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হবে।

এ বছর নারী দিবসের Theme Color হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে তিনটি রঙ : বেগুনি, সবুজ ও সাদা।

এর মধ্যে বেগুনিকে বেছে নেওয়া হয়েছে ন্যায় ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে, সবুজকে আশাবাদের জন্য এবং সাদা এখানে পবিত্রতা নির্দেশ করছে। অবশ্য নারীর সঙ্গে সবসময় ‘পবিত্রতা’র এই ধারণাটি আরোপ করা যে বিতর্কিত, ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স ডে ওয়েবসাইটে তা স্বীকারও করা হয়েছে।

এবার আসি মূল প্রশ্নে, সব মিলে তাহলে কি পাচ্ছি আমরা?

আমাদের এই বিষয়ে জানার জন্য নারীবাদী আন্দোলনের চার ধারা ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হবে।

প্রথমটিতে, (First Wave Feminism; ১৯০০-১৯৫৯) মূলত সম্পত্তি ও রাজনীতিতে নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরা হয়েছে।

দ্বিতীয় ধারায় (Second Wave Feminism; শুরু হয় ১৯৬০ সালে) লিঙ্গ বৈষম্য, আইনি বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন এবং নিজের শরীর, যৌনতা ও প্রজনন প্রক্রিয়ায় নারীর মতাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি সামনে আসে। তৃতীয় ধারার নারীবাদী আন্দোলনে।

(Third Wave Feminism; শুরু হয় গত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে : ১৯৯০-২০০০ সাল) উঠে আসে নারীর ব্যক্তিসত্তার প্রসঙ্গ।

২০০০ সালের পর থেকে শুরু হওয়া চতুর্থ ধারায় (Fourth Wave Feminism) যে আন্দোলন চলছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক হয়রানি এবং নারী-বিদ্বেষ বিরোধী জনমত গঠনের প্রচেষ্টা।

এই চারটি ধারায় জীবন ও জীবিকার নানা ক্ষেত্রে নিজের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে নারীকে লড়াই করতে হয়েছে এবং এই লড়াই এখনো চলমান। এই বিষয়গুলোতে নারীর অর্জন অনেক; তবে তা সম্পূর্ণ তো নয়ই, একে যথেষ্টও বলা যায় না।

তাই, নারীর বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্য ও সহিংসতা দূর করতে হবে এবং সমাজের সব মানুষের মধ্যে অসাম্য দূর করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব পরিসরে নারীরা যেন পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষ যেন স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে, এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে Sustainable Development কখনোই achieve করা সম্ভব হবে না।

নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা বৈরি থাকলে চলবে না; একে অন্যের সহযোগী হতে হবে। পুরুষকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। নারীকে পুরুষের চেয়ে ‘দুর্বল ও অধম’ ভাবার একটি চর্চা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে; এর বদল দরকার। পুরুষ কেবল প্রেমেই নারীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, এ ছাড়া অন্যকিছুতে নয়; জীবনে নয়, কর্মে নয়। কিন্তু পরিবারে-সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর তুলনাতীত ভূমিকা বা অবদানের কথা স্বীকার করে তার কাছে পুরুষের শ্রদ্ধায় আনত হওয়া উচিৎ। নারীর কাছে শুধু প্রেমে নয়, শ্রদ্ধায়ও নতজানু হওয়া চাই। এই বোধ যেদিন পুরুষের হবে, সমাজের হবে, সেদিন সমাজ বদলাবে- এর আগে নয়।

এজন্য আমাদের সবাইকে নিজেদের প্রথাগত ও অনুদার মানসিকতা বদলাতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন এ বিষয়ে সচেতনতা; হোক না সেটা নারী দিবসকে কেন্দ্র করেই! ভালো কিছু তো কখনো শুরু হতে হয়।